Thursday, May 7, 2020

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে


রবীন্দ্রনাথ
জীবনানন্দ দাশ





         অনেক সময় পাড়ি দিয়ে আমি অবশেষে কোনো এক বলয়িত পথে
                  মানুষের হৃদয়ের প্রীতির মতন এক বিভা
         দেখেছি রাত্রির রঙে বিভাসিত হয়ে থেকে আপনার প্রাণের প্রতিভা
                বিচ্ছুরিত করে দেয় সঙ্গীতের মতো কণ্ঠস্বরে।
                    হৃদয়ে নিমীল হয়ে অনুধ্যান করে   
            ময়দানবের দীপ ভেঙে ফেলে স্বভাবসূর্যের গরিমাকে।
                চিন্তার তরঙ্গ তুলে যখন তাহাকে
               ডেকে যায় আমাদের রাত্রির উপরে 
পঙ্কিল ইতিহাস এক ভেসে ওঠে নেপথ্যের অন্ধকারে: আধো ভূত,আধেক মানব
            আধেক শরীর ― তবু  ―  অধিক গভীরতরভাবে এক শব ।

         নিজের কেন্দ্রিক গুণে সঞ্চারিত হয়ে উঠে আপনার নিরালোকে ঘোরে
         আচ্ছন্ন কুহক, ছায়া, কুবাতাস ―  আধো চিনে আপনার  জাদু চিনে নিতে
   ফুরাতেছে ―  দাঁড়াতেছে। ― তুমি তাকে স্থির প্রেমিকের মতো অবয়ব দিতে
          সেই ক্লীববিভূতিকে ডেকে গেলে নিরাময় অদিতির ক্রোড়ে।
              অনন্ত আকাশবোধে ভরে গেলে কালের দু-ফুট মরুভূমি।
         অবহিত আগুনের থেকে উঠে যখন দেখেছ সিংহ,মেষ, কন্যা, মীন
               ববিনে জড়ানো মমি ―  মমি দিয়ে জড়ানো ববিন, 
                 প্রকৃতির পরিবেদনার চেয়ে প্রামাণিক তুমি
                        সামান্য পাখি ও পাতা ফুল
                 মর্মরিত করে তোলে ভয়াবহভাবে সৎ অর্থসঙ্কুল।

         যেসব বিস্রস্ত অগ্নি লেলিহান হয়ে ওঠে উনুনের অতলের থেকে
                  নরকের আগুনের দেয়ালকে গড়ে,
                 তারাও মহৎ হয়ে অবশেষে শতাব্দীর মনের ভিতরে
                   দেয়ালে অঙ্গার, রক্ত, এক্যুয়ামেরিন আলো এঁকে
                     নিজেদের সংগঠিত প্রাচীরকে ধূলিসাৎ করে
                        আধেক শবের মতো স্থির;
                     তবু শবের চেয়ে বিশেষ অধীর :
                   প্রসারিত হতে চায় ব্রহ্মাণ্ডের ভোরে;
              সেইসব মোটা আশা, ফিকে রঙ, ইতর ফানুস,
              ক্লীবকৈবল্যের দিকে যুগে যুগে যাদের পাঠাল দরায়ুস।

              সে সবের বুক থেকে নিরুত্তেজ শব্দ নেমে গিয়ে
              প্রশ্ন করে যেতেছিল যে-সময়ে নাবিকের কাছে :
              সিন্ধু ভেঙে কত দূর নরকের সিঁড়ি নেমে আছে? 
               তত দূর সোপানের মতো তুমি পাতালের প্রতিভা সেঁধিয়ে
               অবারিতভাবে সাদা পাখির মতন সেই ঘুরুনো আঁধারে
               নিজে প্রমাণিত হয়ে অনুভব করেছিলে শোচনার সীমা 
                   মানুষের আমিষের ভীষণ ম্লানিমা,
               বৃহস্পতিবার ব্যাস শুক্র হোমরের হায়রান হাড়ে
               বিমুক্ত হয় না তবু ―  কী করে বিমুক্ত তবু হয়:
               ভেবে তার শুকনো অস্থি হল অফুরন্ত সূর্যময় ।

               অতএব আমি আর হৃদয়ের জনপরিজন সবে মিলে
               শোকাবহ জাহাজের কানকাটা টিকিটের প্রেসে
               রক্তাভ সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এই অভিজ্ঞের দেশে
               প্রবেশ করেছি তার ভূখণ্ডের তিসি ধানে তিলে ।
               এখানে উজ্জ্বল মাছে ভরে আছে নদী ও সাগর;
               নীরক্ত মানুষদের উদ্বোধিত করে সব অপরূপ পাখি;
               কেউ কাকে দূরে ফেলে রয় না একাকী।
               যেসব কৌটিল্য, কূট, নাগার্জুন কোথাও পায়নি সদুত্তর
               এইখানে সেইসব কৃতদার, ম্লান দার্শনিক
               ব্রহ্মাণ্ডের গোল কারুকার্যে আজ রুপালি সোনালি মোজ়ায়িক।

               একবার মানুষের শরীরের ফাঁস থেকে বার হয়ে তুমি:
               (সে-শরীর ঈশ্বরের চেয়ে কিছু কম গরীয়ান)
               যে-কোনো বস্তুর থেকে পেতেছ সম্মিত সম্মান;
               যে-কোনো সোনার বর্ণ সিংহদম্পতির মরুভূমি,
               অথবা ভারতী শিল্পী একদিন যেই নিরাময়
               গরুড় পাখির মূর্তি গড়েছিল হাতির ধুসরতর দাঁতে,
               অথবা যে-মহীয়সী মহিলারা তাকাতে তাকাতে
               নীলিমার গরিমার থেকে এক গুরুতর ভয়
        ভেঙে ফেলে দীর্ঘছন্দে ছায়া ফেলে প্রথিবীর পৃথিবীর ’পরে, 
               কবিতার গাঢ় এনামেল আজ সেই সব জ্যোতির ভিতরে ।
             

         
               
[উৎসনির্দেশ: ‘পূর্ব্বাশা’ রবীন্দ্র-স্মৃতি সংখ্যা আশ্বিন ১৩৪৮/ সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯৪১;সম্পাদনা সঞ্জয় ভট্টাচার্য]  



সম্পাদকীয় দপ্তর- বেবী সাউ হিন্দোল ভট্টাচার্য মণিশংকর বিশ্বাস সন্দীপন চক্রবর্তী শমীক ঘোষ
এই সংখ্যার পরামর্শদাতা এবং সম্পাদনা সহযোগী শ্রী গৌতম বসু 

No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দ দাশ           অনেক সময় পাড়ি দিয়ে আমি অবশেষে কোনো এক বলয়িত পথে                   মানুষের হৃদয়ের প্...

অন্য ভাবে দেখা